গত ৩১ আগস্ট দুটি গুরুত্বপূর্ণ খবর ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। প্রথমটিতে বলা হয়েছে, কয়লাভিত্তিক দুটি বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা। আর দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে সংসদীয় কমিটি তার অভিমত দিয়েছে। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত্ সঙ্কটের কারণে দুটি সংবাদই আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সংবাদের পেছনেও সংবাদ থাকে। তাই প্রকাশিত দুটি সংবাদের পেছনেও যে আরও সংবাদ থাকবে, তা বলাইবাহুল্য। চট্টগ্রাম ও খুলনায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদুত্ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড। এতে ব্যয় হবে ১৩ হাজার ২০০ কোটি ভারতীয় রুপি, যা কিনা বাংলাদেশী মুদ্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার সমান। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আমদানি করা কয়লা দিয়ে এই কেন্দ্র দুটিতে বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারত সমান অংশীদারিত্বে বিদ্যুত্ কেন্দ্র দুটির ব্যয়ভার বহন করবে। চুক্তির বিস্তারিত আমরা জানি না। সংবাদপত্রে তা প্রকাশিতও হয়নি, তবে ভারতীয় কয়লা আমদানি কেন? আমাদের কি কয়লা সম্পদ নেই, যা দিয়ে আমরা বিদ্যুত্ কেন্দ্র দুটি চালাতে পারি?
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুতের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে ভালো জাতের বিটুমিনাস কয়লা পাওয়া গেছে। উত্তরাঞ্চলের বড় পুকুরিয়ায় যে কয়লা পাওয়া গেছে, তা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১৯ মিটার থেকে ৫৬০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত। মোট ছয়টি কয়লাস্তর পাওয়া গেছে, যার পুরুত্ব সর্বনিম্ন তিন মিটার এবং সর্বোচ্চ বিরাশি মিটার। মোট মজুতের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লা খনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড় পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৪০ মিটার থেকে ১১৫৮ মিটার গভীরতায় ৭টি কয়লাস্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার এবং মোট আনুমানিক মজুতের পরিমাণ ১০৫৩ মিলিয়ন টন। এখানে কয়লা স্তরের গভীরতা বেশি হওয়ায় তা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক হবে কিনা, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। ফলে এ মজুতের উন্নয়নের কাজ আরম্ভ হয়নি। দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া কয়লা খনি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে কয়লা মজুতের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা এশিয়া এনার্জি কর্পোরেশন (বাংলাদেশ)। খনির মেয়াদকালে মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ফুলবাড়ী কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলার কথা, যা এরই মধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ খনিতে বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা হবে ১৫ মিলিয়ন টন। এই কয়লা খনির দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার (উত্তর-দক্ষিণে) এবং প্রস্থ ৩ কিলোমিটার (পূর্ব-পশ্চিমে)। এই খনিটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬৫-২৭০ মিটার গভীরে অবস্থিত।
এসব কয়লাখনি নিয়ে আমাদের দেশে একটি বড় বিতর্ক চলছে—আর তা হচ্ছে কয়লা আমরা তুলব কীভাবে? ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? উন্মুক্ত পদ্ধতির প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড বা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ। এতে ঝুঁকিও বেশি। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। অল্প জমিতে অনেক মানুষ বাস করেন। সমস্যা হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুলতে হলে অনেকে জমি হারাবেন। ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে, এর প্রায় ৮০ শতাংশই কৃষি জমি। প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে প্রকল্পকালে প্রায় ২ হাজার ৩০০ আদিবাসীসহ ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ও পুনর্বাসিত করতে হবে। এই কাজটি ১০ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এখানে ১০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত্ উত্পাদন করার কথা। এটা বলা হয়ে থাকে যে, ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প চালু হলে প্রতি বছর জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ সংযোজন হতে পারে। প্রকল্প মেয়াদকালে জিডিপিতে অবদান রাখবে প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ফুলবাড়ীর জনগণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিরোধিতা করে আসছে সেই প্রথম থেকেই। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লা খনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ৬ জন মানুষ। এশিয়া এনার্জির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তারও বিরোধিতা করছে একটি জাতীয় কমিটি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, সেই জটিলতা এখনও দূর হয়নি। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির বৈঠকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে মত দেয়া হয়েছে। তারা কয়লানীতি দ্রুত চূড়ান্ত করারও সুপারিশ করেছে। আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা চূড়ান্ত হওয়ার কথা। এই যখন পরিস্থিতি এবং যেখানে দেশে প্রচুর কয়লা সম্পদ রয়েছে, সেখানে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত—এ প্রশ্ন করাই যায়। এতে করে ভারতের উপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। আগামীতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে, তাহলে এই কয়লা আমদানির উপর তা কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা, আমরা তা জানি না। বলা হচ্ছে বিদ্যুত্ কেন্দ্র দুটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা দেশ দুটো সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এ ক্ষেত্রে ভারত যা ব্যয় করবে, তা তুলে নেবে কীভাবে? এই চুক্তিটি বহাল থাকবে কত বছরের জন্য? এসব বিষয় বিস্তারিত জানা দরকার। এটা ভালো হয় যদি তা সংসদে উপস্থাপন করা হয়। এতে করে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের একটি সুযোগ তৈরি হলো। এর মধ্য দিয়ে আমাদের বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এটা জানার সুযোগ পাবেন যে, বিদ্যুত্ কেন্দ্র দুটির জন্য যে কয়লার প্রয়োজন, তা আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারতাম কিনা? দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কিনা? তৃতীয়ত, ভারতীয় ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়াটি কী? চতুর্থত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোনো ‘তৃতীয়পক্ষ’-এর উপস্থিতি রয়েছে কিনা?
ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত্ সঙ্কটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ আমাদের জন্য একটি ‘আশার আলো’। কিন্তু যেহেতু দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে, সেহেতু এই চুক্তি যেন আমাদের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে না দাঁড়ায়! একই সঙ্গে সংসদীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যে সুপারিশ করেছে, আমি তাকে স্বাগত জানাই। তবে ফুলবাড়ীর মানুষদের কথা মনে রাখতে হবে। কয়লা সম্পদের ভাগিদার তারাও। তাদের পুনর্বাসনই শুধু নয়, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফুলবাড়ীর কয়লা সম্পদের ‘হক’ তাদের আছে। এই ‘হক’ থেকে তাদের আমরা বঞ্ছিত করতে পারি না। রাষ্ট্র এ অঞ্চলের সম্পদ জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা। দেশে এরই মধ্যে একটি ‘জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন থেকেই দেশের জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়ে আসছে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলাটাও জরুরি। তবে এটা ঠিক বাংলাদেশের কয়লা ব্যবহার না করে কেন ভারতীয় কয়লা আমদানি করব—এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা আমরা জানি ভারতীয় কয়লায় পরিবেশ দূষণ হয় সবচেয়ে বেশি। সেই তুলনায় আমাদের কয়লার মান অনেক ভালো। মনে রাখতে হবে যেখানে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিমাণ ৭৯ শতাংশ, চীনে ৭৮ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৯ শতাংশ, কিংবা ভারতে ৬৯ শতাংশ, সেখানে আমাদের কয়লা সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশে ২০১২ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০২০ সালে ১৬৮০৮ মেগাওয়াট, তখন কয়লা ছাড়া আমাদের কোনো ‘বিকল্প’ নেই। গ্যাস সম্পদ ফুরিয়ে আসছে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। সে ক্ষেত্রে কয়লা সম্পদ আমাদের জন্য একটি ভরসা। কিন্তু এই কয়লা সম্পদকে ব্যবহার না করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কয়লা আমদানি করলে বিতর্ক তো বাড়বেই। আমরা চাই এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হোক। আমরা বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়াতে চাই; কিন্তু পরনির্ভরশীল হতে চাই না।
ড. তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
লেখক : নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক
[email protected]